ইসলামে শ্রম ও শ্রমিকের মর্যাদা
ইসলামে শ্রম ও শ্রমিকের মর্যাদা
লেখকঃ আজিজুল হাকিমবিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
فَاِذَا قُضِیَتِ الصَّلٰوۃُ فَانۡتَشِرُوۡا فِی الۡاَرۡضِ وَابۡتَغُوۡا مِنۡ فَضۡلِ اللّٰہِ وَاذۡکُرُوا اللّٰہَ کَثِیۡرًا لَّعَلَّکُمۡ تُفۡلِحُوۡنَ
অতঃপর নামায শেষ হয়ে গেলে তােমরা যমীনে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান কর, এবং আল্লাহকে স্বরণ কর বেশি বেশি যাতে তােমরা সফলকাম হও।
আল জুমুআহ - ১০
মহান আল্লাহ তাআলা উক্ত আয়াতে কারীমায় শ্রমের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বলেছেন, নামায যখন শেষ হয়ে যাবে তখন তোমরা মসজিদে বসে না থেকে বরং নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়বে। আল্লাহর দেয়া রিজিক তালাশ করবে।
ইসলামই একমাত্র শ্রমিকের যথাযথ সম্মান প্রদান করেছেন। তাই শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে ইসলামের কোন বিকল্প নেই। শুধু ১মে আসলে ঘটা করে মে দিবস উৎযাপন করে একদিন সরকারী ছুটি প্রদান করলেই শ্রমিকের অধিকার আদায় হয় না বরং এটি শ্রমিকদের সাথে রসিকতা। বরং শ্রমিকদের শ্রমের ন্যায্য দাম দিলেই তাকে সম্মান দেখানো হয়। আসুন দেখি সোনালী অতীতে রাসূল সাঃ শ্রম এবং শ্রমিককে কিভাবে মূল্যায়ণ করতেন!
যে ব্যক্তি নিজে উপার্জন করে খায় সে আল্লাহর বন্ধুঃ
হাদীস শরীফে এসেছে,
রাসূলুল্লাহ সাঃ খেটে খাওয়া মানুষের মর্যাদা বর্ণনা করে ঘোষণা করেন, আল-কাসিবু হাবীবুল্লাহ অর্থাৎ “শ্রমিক হলো আল্লাহর বন্ধু”
কানযুল উম্মাল, ৪র্থ খন্ড, পৃ. ১২৭
শ্রমের মর্যাদাঃ
হযরত আবূ হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত। নবী করীম সাঃ বলেন, “কোনো ব্যক্তি তা থেকে উত্তম আহার করেনি, যা সে নিজ হাতে উপার্জন করে খেয়েছে। আল্লাহর নবী দাউদ আঃ নিজ হাতে উপার্জন করে খেতেন”
মাজমা‘উয যাওয়াইদ ওয়া মাম্বাউল ফাউয়াইদ, পৃ. ৬১
হযরত মিকদাম ইবনে মাজদী কুরায়ব আয্-যুবায়দী রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি নবী করীম সাঃ থেকে বর্ণনা করেন, নবী করীম সাঃ বলেন, “মানুষের নিকট তার চেয়ে কোনো উত্তম উপার্জন নেই, যা সে নিজের হাতে উপার্জন করে খায়। সে যা কিছু নিজের জন্য, পরিবার-পরিজনের জন্য ও ঘরের ভৃত্যদের জন্য খরচ করে তা সবই সাদাকা”
সহীহুল বুখারী, পৃ. ১৯২
শ্রমিককে আল্লাহর রাসূল সাঃ মর্যাদা দিয়েছেনঃ
হযরত সা’দ রাঃ কামারের কাজ করতেন, হাতুড় দিয়ে কাজ করতে করতে তার হাত দু’টি বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল। একদিন নবী করীম সাঃ এর সাথে করমর্দন করার সময় সাদকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, হাতুড় দিয়ে কাজ করতে গিয়ে এ অবস্থা হয়েছে। নবী করীম সাঃ তার হাত চুম্বন করে বললেন, “এ হাতকে কখনো আগুন স্পর্শ করবে না”
সহীহুল বুখারী, পৃ. ৪
ভিক্ষাবৃত্তি থেকে শ্রমের মর্যাদা অনেক বেশীঃ
রাসূলুল্লাহ সাঃ ঘোষণা করেন, “ঐ সত্তার কসম যাঁর হাতে আমার জীবন! তোমাদের কারও পক্ষে এক গাছা রশি নিয়ে বের হওয়া এবং কাষ্ঠ সংগ্রহ করে পিঠে বোঝাই করে বয়ে আনা কোনো লোকের কাছে গিয়ে ভিক্ষা চাওয়ার চেয়ে উত্তম। অথচ সে ব্যক্তি তাকে দান করতেও পারে অথবা তাকে বিমুখও করতে পারে”
সহীহুল বুখারী, ১ম খন্ড, পৃ. ৩২৫; জামি‘উত্-তিরমিযী, ১ম খন্ড, পৃ. ১৪৭; সুনানুন্-নাসা’ঈ, ১ম খন্ড, পৃ. ৩৬২
অন্যান্য নবী এবং রাসূলে কারীম সাঃ নিজেও শ্রম দিয়েছেনঃ
হযরত আবু হুরাইরা রা থেকে বর্ণিত তিনি নবীজি থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূল সাঃ বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা যত নবী রাসুল পাঠিয়েছেন সকলে ছাগল চরিয়েছেন। সাহাবীগণ বললেন হে আল্লাহর রাসূল আপনিও কি চরিয়েছেন ? তখন রাসুল সাঃ বললেন হ্যাঁ! আমি কয়েক কেরাতের বিনিময়ে মক্কাবাসীদের ছাগল চরিয়েছি। (শ্রম খেটেছি)।
বুখারী, খন্ড, ১ পৃষ্ঠা নং, ৩০১ হাদীস, ২২০৭
নবীজি সাঃ বলেন, কারও জন্য নিজ হাতের উপার্জন অপেক্ষা উত্তম আহার্য বা খাদ্য আর নেই। আল্লাহর নবী দাঊদ আঃ নিজ হাতের কামাই খেতেন
বুখারী, খন্ড, ১ পৃষ্ঠা নং, ২৭৮ হাদীস, ২০২৫
হযরত উতবাহ ইবনে নুদ্দার রাঃ থেকে বর্ণিত
তিনি বলেনঃ একদা আমরা রাসূল সাঃ এর দরবারে উপস্থিত ছিলাম সে সময় তিনি সূরা ‘তা সীন মিম’ তেলাওয়াত করতে করতে মুসা আঃ এর ঘটনা পর্যন্ত পৌঁছেছেন, তখন রাসুল সাঃ বলেছেন যে, আল্লাহর নবী হযরত মুসা আঃ ও নিজের লজ্জা স্থানের হেফাজত ও পেটের ক্ষুধা নিবারণের জন্য ৮/১০ বছর শ্রম খেটেছেন।
মেশকাত, পৃষ্ঠা নং, ২৫৮
আমাদের প্রথম নবী হজরত আদম আঃ ছিলেন দুনিয়ার প্রথম চাষি,
হজরত শুয়াইব আঃ ও হজরত হারুন আঃ এর পেশা ছিল পশু পালন ও দুধ বিক্রি।
হজরত মুসা আঃ ছিলেন একজন রাখাল। ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর রাঃ এবং মহানবি হজরত মুহাম্মদ সাঃ ছিলেন সৎ ব্যবসায়ী।
এছাড়াও হজরত লুত ও হজরত শিস আঃ ছিলেন কৃষক,
হজরত ইদরিস আঃ ছিলেন দর্জি,
হজরত নুহ আঃ ছিলেন কাঠমিস্ত্রি,
হজরত ইবরাহিম আঃ হজরত ইয়াকুব আঃ হজরত হুদ আঃ সালেহ আঃ ছিলেন ব্যবসায়ী।
শ্রমিককে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে রাসূল সাঃ এর কঠোর নির্দেশ প্রদানঃ
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সাঃ বলেছেন যে, শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকিয়ে যাওয়ার আগে তার পারিশ্রমিক দিয়ে দাও।
মেশকাত, পৃষ্ঠা নং ২৫৮
হযরত আবু হুরাইরা রা থেকে বর্ণিত তিনি বলেন রাসূল সাঃ বলেছেন যে, মহান আল্লাহ ফরমান জারি করেছেন যে, কিয়ামতের দিন আমি তিন ব্যাক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নেব।
১. যে ব্যক্তি আমার নামে শপথ করে, প্রতিশ্রুতি দেয় অতঃপর ওয়াদা ভঙ্গ করে।
২. যে ব্যক্তি কোন স্বাধীন লোক কে বিক্রি করে মূল্য খেয়ে ফেলল । (তাকে কৃতদাস বানিয়ে দিল)
৩. যে ব্যক্তি শ্রমিক নিয়োগ করে কাজ আদায় করে নিল কিন্তু শ্রমের পারিশ্রমিক প্রদান করল না।
বুখারী, খন্ড, ১ পৃষ্ঠা নং, ৩০২ হাদীস ২২১৫
রাসূল সাঃ বলেছেন, “তোমাদের অধীন ব্যক্তিরা তোমাদের ভাই। আল্লাহ তায়ালা যে ভাইকে তোমার অধীন করে দিয়েছেন তাকে তা-ই খেতে দাও, যা তুমি নিজে খাও, তাকে তা-ই পরিধান করতে দাও, যা তুমি নিজে পরিধান কর।”
বুখারী, খন্ড, ১ পৃষ্ঠা নং, ৩৪৬ হাদীস, ২৪৭৫
হজরত আবু বকর রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাঃ বলেন- ‘অধীনস্থদের সাথে দুর্ব্যবহারকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’
ইবনে মাজাহ, পৃষ্ঠা নং ২৬৯৭
সুদীর্ঘ আলোচনার পরে এটি স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, একমাত্র ইসলামের বিধান মেনে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালিত হলেই শ্রমিক তার যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা লাভ করবে।
No comments